বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের এক নির্দোষ শিকার। ইউএনএফসিসিসি বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে মানুষের কারণে সৃষ্ট আর জলবায়ুর বিভিন্নতাকে অন্য কারণে সৃষ্ট জলবায়ুর পরিবর্তন বোঝাতে ব্যবহার করে। একথা অনস্বীকার্য যে, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণে নয়, বরং অধিকতর মনুষ্যসৃষ্ট কারণেই হয়ে থাকে।
কোনো দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সত্যিই পড়ছে কিনা, তা চারটি মানদন্ডে বিবেচনা করা হয়:
১) জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত;
২) কোথায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হয়েছে;
৩) সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা কোথায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে;
৪) ক্ষতিগ্রস্ত দেশটিতে ক্ষতি মোকাবেলায় বা অভিযোজনের জন্য এরই মধ্যে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে।
বাংলাদেশ একাধারে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি সবগুলো দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত। তাই এই চারটি মানদন্ডেই বাংলাদেশ, জলবায়ুপরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় শীর্ষে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। প্রাকৃতিক কারণ ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণ। প্রাকৃতিক কারণগুলির মধ্যে রয়েছে সূর্যের শক্তি উৎপাদনে হ্রাস-বৃদ্ধি, মহাসাগরের উত্তাপ শক্তির পরিবর্তন, সমুদ্রস্রোতের পরিবর্তন, মহাদেশসমূহের স্থান পরিবর্তন, আগ্নেয়গিরির দূষণ ও এলনিনো এবং লানিনার প্রভাব ইত্যাদি। এই পরিবর্তনগুলো অতিপ্রাকৃত এবং এতে হস্তক্ষেপ করা অসাধ্য। এই পরিবর্তনগুলো চলমান, যা সৃষ্টির শুরু থেকেই হয়ে আসছে এবং মানুষও এর সাথে প্রতিনিয়ত খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। বরং পরিবেশের উপর মানুষের অনিয়ন্ত্রিত হস্তক্ষেপের জন্যই জলবায়ু পরিবর্তন আজ এই পর্যায়ে পৌঁছেছে।
শিল্পবিল্পবের পর ১৯ শতকের সূচনালগ্ন থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন, কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া, বন উজাড়, জৈবিক পচন, কৃষিক্ষেত্রে সার ও কীটনাশকের অযাচিত ব্যবহারসহ বহুবিধ কারণে বায়ুমন্ডলে বিভিন্ন প্রকার গ্যাস বিশেষ করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, সিএফসি, গ্রিন-হাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সূর্য থেকে আগত তাপরশ্মিকে পুনরায় মহাকাশে প্রতিফলিত হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে, ফলে পৃথিবী ক্রমাগত উষ্ণ হচ্ছে, আবহাওয়ার ধরণ এবং ঋতুবৈচিত্র্য পাল্টে যাচ্ছে। আইপিসিসির সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হচ্ছে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। যার ফলে মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলিই প্রধান চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত।
লবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য আমরা দুইটি কৌশল অবলম্বন করতে পারি। একটি হলো জলবায়ু পরিবর্তনের হার কমানো এবং অপরটি জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো বা অভিযোজন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হচ্ছে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি। সুতরাং বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন এর পরিমাণ কমাতে কয়লা, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। এর জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি, যেমন- সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ইত্যাদি ব্যবহার বাড়াতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে শক্তির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। স্বল্প সালফারযুক্ত ডিজেল ব্যবহারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। গ্রিন-হাউজ গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনতে উন্নত ‘বন্ধুচুলা’ ব্যবহারকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। কৃত্রিম রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করে জৈবিক সার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দূষণ কারীর নিকট হতে ক্ষতি পূরণ আদায় নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
জলবায়ুর যে পরিবর্তন ইতোমধ্যে সাধিত হয়েছে তার সাথে আমাদের খাপ খাওয়াতে শিখতে হবে। পরিবর্তিত জলবায়ুতে বেঁচে থাকার জন্য গৃহীত কর্মসূচিই হলো জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো বা অভিযোজন। অভিযোজনের উদ্দেশ্য হলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি কমানো ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ। যেমন (১) ঘরবাড়ি, বিদ্যালয়, কলকারখানা ইত্যাদি অবকাঠামোর উন্নয়ন। (২) বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ। (৩) উপকূলীয় বন সৃষ্টি। (৪) লবণাক্ত পরিবেশে বাঁচতে পারে এমন ফসল উদ্ভাবন। (৫) জীবন যাপনের ধরন পরিবর্তন। (৬) জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কিত ধারণা সকলকে জানানো।
আমাদের পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবেশগত, অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে পাল্টে যাচ্ছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেইসাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের চাহিদা, বাড়ছে ভোগ-বিলাসের পরিমাণ। চাহিদা মেটাতে মানুষ নিজেদের উন্নতি ও আয় বৃদ্ধির কথা ভাবছে, বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কাজ করছে। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে বিপর্যস্ত হচ্ছে আমাদের সামগ্রিক পরিবেশ পাশাপাশি জীব বৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে। এ ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম টেকসই নয়।
টেকসই উন্নয়ন এমন একটি উন্নয়ন প্রক্রিয়া যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনার সাথে আপোস না করে কীভাবে বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা মেটানো হবে তা নির্ধারণ করে এবং প্রকৃতিকে ঠিক রেখে উন্নয়ন কর্মকান্ড সম্পাদন করে। টেকসই উন্নয়ন শুধুমাত্র পরিবেশ সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, বরং তা সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নেরও আওতাভুক্ত। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ ঘোষণা করেছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি)। এর মাধ্যমে পৃথিবীতে সহযোগিতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এতে ১৭টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে বিশ্ব পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে এসডিজি অর্জনের কাজ শুরু হয়েছে, যা শেষ হবে ২০৩০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এরমধ্যে ১৩ নম্বর লক্ষ্যটি হলো, জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবেলায় জরুরি কর্মব্যবস্থা গ্রহণ।
কৃত্রিম সার ও কীটনাশক ব্যবহার এবং চারণ ও বনভূমি উজাড়ের মতো কৃষিকাজগুলি বায়ুমন্ডলে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত গ্রিন-হাউজ গ্যাস নির্গমনে অবদান রাখে। জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করার জন্য বায়োটেকনোলজি বা জৈবপ্রযুক্তি একটি অন্যতম নির্ভরযোগ্য উত্তর। জিনগতভাবে পরিবর্তিত শস্য রোপণ গ্রিন-হাউজ গ্যাস নির্গমনকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করে। এ ধরনের ফসলে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয় না বিধায় কৃষকদের তাদের সরঞ্জামগুলো বৈদ্যুতায়িত করতে হয় না, এতে জ্বালানি নষ্ট হচ্ছে না, ফলে গ্রিন-হাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস পাচ্ছে। নির্গত গ্রিন-হাউস গ্যাসের এই হ্রাস কোনো নগণ্য হ্রাস নয়। ২০১২ সালে বায়ুমন্ডল থেকে ২ বিলিয়ন কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ হয়েছে, যা প্রায় এক বছরের জন্য ১১.৯ মিলিয়ন গাড়ি অপসারণের সমান। এটি কার্বন ফুটপ্রিন্ট হ্রাস করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
এই প্রযুক্তি কৃষকদের পরিবেশবান্ধব শক্তি এবং সার ব্যবহার করতে এবং মাটির কার্বন-সিকুয়েস্ট্রেশন অনুশীলনের অনুমতি দেয়। তেলবীজ, আখ, সরষে বীজ এবং যাত্রোফার মতো ঐতিহ্যবাহী এবং জীনগতভাবে পরিবর্তিত ফসল হতে জৈব জ্বালানির উৎপাদন, পরিবহন খাতে দূষণের বিরূপ প্রভাব হ্রাস করতে সহায়তা করে। বহুবর্ষজীবী অভোজ্য তেল-বীজ রোপনের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলের দূষিত পদার্থ পরিষ্কার করতে সহায়তা করবে। শক্তি খাতে সরাসরি ব্যবহারের জন্য বায়ো-ডিজেল উৎপাদনের সাথে সরাসরি জড়িত হওয়া যাবে, যা জীবাশ্ম জ্বালানির সাথে মিশ্রিত হয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নির্গমন হ্রাস করতে সহায়তা করবে।
সন্দেহ নেই যে, পরিবেশ মানবতার প্রযুক্তিগত অগ্রগতি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। দূষিত পদার্থ এবং দূষণ আমাদের বায়ু, জল এবং মাটিতে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। এই দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বিজ্ঞানীরা বায়োরিমেডিয়েশন এর জৈবিক এজেন্ট ব্যবহার করছেন। বায়োরিমেডিয়েশন দূষিত মাধ্যমকে পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করার জন্য জীবিত প্রাণীদের ব্যবহার করে দূষিত পদার্থ গ্রহণের জন্য ডিজাইন করা। এই প্রযুক্তিটি দূষিতবর্জ্য, পানি, ভূগর্ভস্থ পানি, মাটি এবং বায়ুর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, যেখানে দুর্ঘটনাক্রমে ইচ্ছাকৃতভাবে দূষণকারী বা রাসায়নিকের মুক্তি হয়েছে যা মানুষ, প্রাণী বা পুরো বাস্তুতন্ত্রের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে।
সুতরাং আধুনিক জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে ইতিবাচকভাবে হ্রাস করা সম্ভব। জিনগতভাবে পরিবর্তিত স্ট্রেস সহনশীল এবং উচ্চফলনশীল ট্রান্সজেনিক ফসলের ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিক জৈব প্রযুুক্তি জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবগুলোকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিহত করতে সক্ষম।