ইংরেজ জাতি সভ্যতা, কৃষ্টি, শিক্ষা-দীক্ষায়, আচার-আচরণে যেমন মার্জিত তেমনি তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও ঐতিহ্যমণ্ডিত। অর্থাৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাদের ঐতিহ্যের ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমনকি তাঁদের জীবন দর্শনে, শিক্ষা ব্যবস্থায়, শিক্ষা প্রশাসন ও তার গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের প্রতিক্ষেত্রে তাঁদের ঐতিহ্যের প্রভাব পড়ছে। ইংরেজদের জাতীয়তাবোধে, রক্ষণশীলতায়, কৌলিণ্যে, আমলাতান্ত্রিকতায় ইত্যাদি সব কিছুতেই একটি আভিজাত্যের প্রতিফলন দেখা যায়। তাঁদের শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক রূপদানের বিরামহীন প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা রয়েছে। যুক্তরাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত ধারাবাহিক বিবরণ নিচে দেওয়া হলো।
১৯৮৮ সালের স্থানীয় সরকার শিক্ষা আইন
১৮৮৮ সালে এক স্থানীয় সরকার আইন দ্বারা প্রশাসনের ও শিক্ষার উন্নয়নে বহুমুখী ভূমিকা পালনের উদ্দেশ্যে কাউন্টি ও কাউন্টি বড়ো প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো পরবর্তীকালে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান ভিত্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯০২ সালের বেলফোর শিক্ষা আইন
১৯০২ সালে বেলফোর শিক্ষা আইন প্রণয়ন করা হয়। এই ফেলফোর শিক্ষা আইন দ্বারা স্কুল বোর্ড, স্কুল অ্যাটেন্ড্যান্স কমিটি ও টেকনিক্যাল ইন্সট্রাকশন কমিটি উঠিয়ে দেয়া হয় এবং তৎস্থলে ৩০০টি স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ (Local Education Authority) প্রতিষ্ঠা করে সমগ্র দেশের শিক্ষার বিকাশ ও প্রসারের দায়িত্ব Local Education Authority-এর উপর অর্পণ করা হয়। এই আইন স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষকে নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক উত্তর স্তরের শিক্ষা প্রসারের জন্য গ্রামার স্কুলগুলোকে অর্থ সাহায্য প্রদানের নির্দেশ দেয়। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য মিউনিসিপ্যাল ট্রেনিং কলেজ প্রতিষ্ঠা ও কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্যও স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব পালন শুরু করে।
১৯২১ সালের মাধ্যমিক শিক্ষা আইন
১৯২১ সালের শিক্ষা আইনের দ্বারা মাধ্যমিক স্কুলগুলো পরিচালনার দায়িত্ব কাউন্টি ও কাউন্টি বড়ো কাউন্সিলের উপর দেয়া হয়। স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব নির্ধারিত করে দেওয়া হয়।
১৬ বছর পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় এবং শিক্ষার্থীদের আর্থিক সাহায্য প্রদান ও বৃত্তিমূলক নির্দেশনা প্রদানের ভার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পালন করতে শুরু করে। ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী ছেলে মেয়েরা যাতে স্কুলে অধ্যয়ন করে তজ্জন্য পিতামাতার উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং এই আইন ভঙ্গ করলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৯৩৬ সালের শিক্ষা আইনে সনদ প্রদানের ব্যবস্থা
১৯৩৬ সালের শিক্ষা আইনে শিক্ষার্থীদের ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এছাড়া ১৪ বছর বয়সে ছাত্রছাত্রীদের চাকুরির সুবিধার্থে সার্টিফিকেট প্রদানের দায়িত্ব স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষের উপর অর্পিত হয়। পরবর্তীকালে এই আইন ইংল্যান্ডের সুবিখ্যাত ১৯৪৪ সালের শিক্ষা আইনের মাধ্যমে অতীতের খণ্ড খণ্ড সংস্কার প্রচেষ্টাগুলো সমন্বিত করে জাতীয় শিক্ষা প্রবর্তন ও উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করে। যুক্তরাজ্যের স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ এই আইন বলে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের সকল প্রকার শিক্ষার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষের অধীনে ইংল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা নিম্নলিখিত স্তরে বিভক্ত।
প্রাথমিক শিক্ষা
নার্সারী হতে ১১ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের শিক্ষা এই স্তরের অন্তর্গত।
- শিশুর ৫ বছর বয়স পর্যন্ত নার্সারী ও কিন্ডার গার্টেন শিক্ষার সময় নির্ধারিত;
- ইনফ্যান্ট স্কুলে ৬-৭ বছর পর্যন্ত;
- জুনিয়র স্কুলে ৭-১১ বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করা হয়।
মাধ্যমিক শিক্ষা
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা তিন ধরনের স্কুলে।
যেমন—
- গ্রামার স্কুল
- টেকনিক্যাল স্কুল
- মডার্ন স্কুলে দেওয়া হয়।
সকল তরুণ-তরুণীরা এ শিক্ষার সুযোগ লাভ করে। তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে একই ক্যাম্পাসে তিন রকম মাধ্যমিক স্কুলের ব্যবস্থা করতে পারে। এছাড়াও সকল প্রকারের মাধ্যমিক স্কুলের মর্যাদা দানের অধিকারও স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করে।
বাধ্যতামূলক শিক্ষা শেষে অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তরুণ-তরুণীদের জন্য নিয়মিত ও খণ্ডকালীন এবং বৃত্তি ও পেশামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করার দায়িত্বও স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ পালন করে থাকে।
বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা
স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ বিশেষ শিক্ষার জন্য নিম্নলিখিত দায়িত্ব পালন করে থাকে:
- বিকলাঙ্গ ও পঙ্গুদের জন্য বিশেষ স্কুলে শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
- সকল শিক্ষার্থীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
- দ্রুরতম এলাকার ছেলেমেয়েদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা করা।
- প্রয়োজনবোধে দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের পোষাক সরবরাহ করা।
- অবসর বিনোদন, শরীর চর্চা ও অন্যান্য কার্যাবলির জন্য পর্যাপ্ত সুযোগের ব্যবস্থা করা।
- বিনামূল্যে সকালে দুধ বিতরণ ও দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা।
- প্রতি বিদ্যালয়ে সমষ্টিগত উপাসনার মাধ্যমে দৈনন্দিন শিক্ষাদান করা।
- সকল প্রকার বিদ্যালয়ে নিয়মিতভাবে ধর্ম শিক্ষাদান করা হয়।
যুক্তরাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা (Education Management in United Kingdom)
বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চ শিক্ষা ছাড়া ইংল্যান্ডের সকল প্রকার শিক্ষার দায়িত্ব স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষের উপর ন্যস্ত। কাউন্টি, কাউন্টি বরো ও আউটার লন্ডন বরোসমূহ কর্তৃক নির্বাচিত কাউন্সিলই স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করে। এই কাউন্সিলগুলো তাদের নিজস্ব এলাকার শিক্ষা কমিটি নিয়োগ করে। শিক্ষা কমিটির অধিকাংশ সদস্য কাউন্সিল সদস্য হতে নিয়োগ করা হয়। এছাড়া শিক্ষা সম্পর্কে অভিজ্ঞ স্থানীয় এলাকার ব্যক্তিকেও শিক্ষা কমিটির সদস্যরূপে মনোনীত করা হয়।
এই শিক্ষা কমিটির কার্য পরিচালনার জন্য একজন চীফ এডুকেশন অফিসার নিয়োগ করেন। তিনি তাঁর অধীনস্থ কর্মচারী ও একদল বিশেষজ্ঞ দ্বারা স্থানীয় এলাকার শিক্ষা পরিচালনা করেন।