শওকত ওসমান এর (১৯১৭-১৯৯৮) উপন্যাস সমূহ
বাংলদেশের উপন্যাসে শওকত ওসমান আঙ্গিকগুণেই আলাদা। বিচিত্রধর্মী উপন্যাস লিখেছেন, আরবি-ফারসি শব্দে, মুসলিম মিথকে গুরুত্ব দিয়ে, রূপক-প্রতীকের ভেতর দিয়ে। তবে চরিত্রের অন্তস্তল স্পর্শ, সামগ্রিক স্বরূপ নির্দেশ তাঁর কাহিনিতে দুর্বল, সমতলও মনে হয়। কিন্তু অনেক উপন্যাসের ভেতর দিয়ে গোড়া থেকেই তিনি প্রতিষ্ঠার জায়গায় পৌঁছান।
জননী (১৯৬১) উপন্যাস
শওকত ওসমানের জননী (১৯৬১) উপন্যাসে জননী দরিয়াবিবির সর্বংসহা মাতৃমূর্তির স্বরূপ আছে। সংসার-পলাতক, নিরুদ্দেশ স্বামী আজহার খাঁর স্থানে দারিদ্র্য-দৈন্যতার সুযোগে অনাহুত অধিকার করে ধনাঢ্য ইয়াকুব। ফলে স্খলিত জননী মর্যাদা হারায়, তাকে ছেড়ে চলে যায় সন্তান মোনাদীর আর অনাগত নিষ্পাপ সন্তানকে চরম পরাকাষ্ঠায় জন্ম দিয়ে মা হিসেবে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। উপন্যাসে মাতৃত্বকে মহীয়ান করার পাশাপাশি বাঙালি মুসলিম সমাজ-সংস্কৃতির আবহমান রূপ ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রকোপকে গভীর তাৎপর্যে বাঙময় করে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস।
বনীআদম (১৯৪৩)
জননীর আগে লেখা হয় বনীআদম (১৯৪৩)। আদম সন্তানের দুঃখ-দারিদ্র্য, হারেসের স্বীকারোক্তি ও সংগ্রামে বর্ণিত। কাহিনিগ্রন্থি শিথিল; চরিত্রানুগ নয় আবহ। তবুও উপন্যাসের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার চিত্র প্রশংসনীয়।
ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২)
ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২) প্রতীকী উপন্যাস। আইয়ুবের বন্দিদশা থেকে পূর্ব-বাংলার জনতার মুক্তি; প্রতীক খলিফা হারুনর রশীদ এবং তার বিপরীতে তাতারীর মুক্তি। মুক্তির ভেতর দিয়ে তাতারীর প্রেম, মর্যাদা, মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধ সবকিছুরই প্রকাশ ঘটেছে। পাকিস্তানী শাসনামলে পূর্ব-বাংলার বাঙালি জনতার মুক্তির সঙ্গে এ বিষয়গুলোই জড়িত ছিল। শাসক হারুনর রশীদ প্রথমে অমর্যাদা তাচ্ছিল্য করেছিল তারপর অনেক সুবিধা দিয়ে তার জবানকে কিনতে চেয়েছিল; তার প্রেমিকাকে ভুলে যেতে বলেছিল কিন্তু কোনোকিছুর বিনিময়ে বা অনুরাগ-বিরহে বশবর্তী হয়ে সে কিছুই করেনি। শওকত ওসমানের এ উপন্যাসের মেসেজটিই জরুরি। উপন্যাসের কাহিনি একটা লক্ষ্যের অনুবর্তী; সেজন্য সংলাপ, ভাষা, ঐতিহ্যিক বিষয় আছে কিন্তু শেষাবধি চিত্তমুক্তির প্রবণতাটিই মুখ্য হয়ে উঠেছে। উপন্যাসটি জনপ্রিয়তার কারণও সেখানেই নিহিত। শওকত ওসমানের চৌরসন্ধি (১৩৭৫)র গুরুত্ব কাল্লু চরিত্রের জন্য। রিক্সাওয়ালা থেকে চোরসম্রাট হওয়ার সংবাদ থাকলেও গ্রাম ও নগর বাস্তবতার চিত্রণে উপন্যাসের আঙ্গিক তাৎপর্যবহই বটে।
শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস
শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস চারটি। জাহান্নম হইতে বিদায় (১৯৭১), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), দুই সৈনিক (১৯৭৩), জলাঙ্গী (১৯৭৪)। জাহান্নম হইতে বিদায় উপন্যাসে গাজী রহমান ১৯৭১-এর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সময়কে বলেন; কাহিনি একাত্তর-এর মধ্যে। প্রত্যক্ষ একাত্তরই কাহিনি হয়েছে। সেখানে মুক্তিযেদ্ধাদের তৎপরতা, রাজাকার নিধন; ভয়-আতঙ্কময় পরিবেশ জ্বলন্ত ও বাস্তব হয়ে ওঠে। নেকড়ে অরণ্য পাক হানাদার বাহিনির হাতে নারী-নির্যাতন ও ধর্ষণের চিত্র। ধর্মের নামে কিংবা ধর্মকে ব্যবহার করে নারী নির্যাতনের চিত্র একাত্তরে নির্মম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। উপন্যাসে তনিমা, সখিনা, আমোদিনীর মনঃকষ্ট তৈরি হয়েছে এ প্রসঙ্গে। দুই সৈনিকের কাহিনি মখদুম মৃধার পরিবারের। যেখানে দুই পাক-মেজর পরিবারের সমস্ত আতিথ্য নিলেও দুই মেয়ের অপহরণের বা ধর্ষণের বাসনা পরিত্যাগ করতে পারে না। পাকিস্তানে ইসলামের নামে গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের দুর্বিষহ ছবি দুই সৈনিক। ছোট্ট পরিসরে লেখক পাকসৈন্যদের প্রবৃত্তি ও লালসার স্বরূপকে তুলে ধরেছেন। যেখানে ধর্মাচার বা মানবিকতা শুধুই হাস্যকর একটি বিষয় মাত্র। জলাঙ্গী বাঁকাজোল গ্রামের জমিরালি; তার মুক্তিযুদ্ধে যাত্রা, শত্রæমুক্তির স্বপ্ন, রাজাকারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, প্রতিশোধ প্রচেষ্টা নিয়ে উপন্যাসের প্লট নির্মিত। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জমিরালির পূর্ণাঙ্গ রূপটি এখানে অঙ্কনের চেষ্টা করেছেন লেখক।
পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩) সমাজ সংগ্রামী, প্রতিরোধাত্মক, জীবনভাবনামূলক উপন্যাস। পঙ্গপালের বিরুদ্ধে অদম্য গফুর। সুবিধাবাদ বা ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে পরিশ্রমী কৃষি জীবনকেই উপন্যাসে প্রতীকী করে তোলা হয়েছে। রাজা উপাখ্যান (১৯৭০) রূপকের আদলে শোষক ও ক্ষমতালিপ্সু জাহুক আর যোগসাজশ বা দালালের প্রতীক হিসেবে দারিয়ুস, জার্জিসকে উপন্যাসে চিত্রায়িত করেছেন। শাহনামাকে মূল কাহিনি ধরে কাল্পনিক ছায়াবৃত্তে রাজা জাহুকের উপাখ্যান রচিত।
সমাগম (১৯৬৭) শওকত ওসমানের বক্তব্যপ্রধান উপন্যাস। আর্তনাদ (১৯৮৫)-এর পূর্বকথায় শওকত ওসমান বলেছেন, ‘ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত আর্তনাদ উপন্যাসে ব্যাকরণ অনেক সময় অবহেলিত।’ কারণ, কাহিনির গতানুগতিক বিভক্তি-বিভাজন-উদ্দেশ্য নেই। দেশভাগ, দাঙ্গা, ভাষা আন্দোলনের কার্যকারণ মূল্যায়ন আছে উপন্যাসে। রাজসাক্ষী (১৯৮৫) রাজনৈতিক চেতনাধর্মী উপন্যাস। সবুরনই রাজসাক্ষী। একদিকে সে নিজের সংগ্রামী জীবনের সাক্ষী অন্যদিকে আদালতে কুচরিত্র কাজী আলামিনের মুখোশ উন্মোচনকারী রাজসাক্ষী। উপন্যাটিতে শওকত ওসমানের মুন্সিয়ানা বেশ রসগ্রাহী।
পিতৃপুরুষের পাপ (১৯৮৬) পিতা জব্বার হাওলাদার মেয়ে লালবানুকে পুঁজি করে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার অভিনব কাহিনি। মেয়ের প্রতি পিতার হঠকারিতা, বিশ্বসঘাতকতা প্রকাশ হলে তা তো পিতৃপুরুষেরই পাপ; সন্দেহ কি! কিশোর উপন্যাস তারা দুইজন (১৯৫৮), পঞ্চসঙ্গী (১৯৭৫), জুজগগা (১৯৮৮)। |