সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক

0

সব্যসাচী লেখক  সৈয়দ শামসুল হক 

লেখক সৈয়দ শামসুল হক:

জন্ম ও পরিবার:

  • জন্ম: ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৫, কুড়িগ্রাম
  • পিতা: সৈয়দ সিদ্দিক হুসেন
  • মাতা: হালিমা খাতুন
  • স্ত্রী: আনোয়ারা সৈয়দ হক (বিবাহ. ১৯৬৫)

উল্লেখযোগ্য কর্ম:

  • উপন্যাস: "খেলারাম খেলে যা", "কথা সামান্যই", "অনুপম দিন", "সীমানা ছাড়িয়ে"
  • কাব্যগ্রন্থ: "পরাণের গহীন ভিতর", "প্রতিধ্বনিগণ", "শব্দই চিকিৎসিত করে"
  • নাটক: "নারীগণ", "ঈর্ষা", "পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়"
  • অনুবাদ: "অচেনা", "কিংবদন্তির দেশে"

পুরস্কার ও সম্মাননা:

  • বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৬)
  • আদমজী সাহিত্য পুরস্কার
  • একুশে পদক (১৯৯৯)
  • স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১১)

মৃত্যু:

  • ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ঢাকা

বিশেষ দ্রষ্টব্য:

  • সৈয়দ শামসুল হক "সব্যসাচী লেখক" হিসেবে পরিচিত ছিলেন কারণ তিনি সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীলভাবে লিখেছেন।
  • তার লেখকজীবন প্রায় ৬২ বছর ব্যাপী বিস্তৃত।
  • তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রখ্যাত লেখক হিসেবে বিবেচিত।

সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬)

সব্যসাচী লেখক বলে পরিচিত হলেও প্রধানত কবি সৈয়দ শামসুল হক। কবিভাষা আরোপিত হয় কাহিনিতে। তবে কথাকারের অঙ্কনরেখা কিছুতেই বিচ্যুত হয় না। শিল্পের শর্তটি টিকে থাকে তাণ্ডব মুখর  কাহিনিতে। সেখানে প্রয়োজনমাফিক প্রবাহ তৈরি হয়, সৃষ্টির অপেক্ষার জন্য অনিবার্যতাগুলি অনির্বচনীয় হয়ে ওঠে। তখন কবি সৈয়দ হক গদ্যকারের পাঠটি আয়ত্ত করে বসেন। নিজের সংযুক্তি ঘটে নাগরিকতার নানা শ্রেণিস্তরের কাঠামোতে। এতেই এমন গুণের জন্য ‘সব্যসাচী’র জয়তিলক থেকে যায়।

অনুপম দিন (১৯৬২) 

অনুপম দিন (১৯৬২) উপন্যাসের বর্ণনায় আধুনিকতা পরিলক্ষিত। ‘পাখা হঠাৎ দুরন্ত গতি পেল। তার বাতাসে যেন ঝড় উঠল বিলকিসের শাড়ীতে, চুলে। পাখার কেন্দ্র থেকে সরে আসতেই আবার শান্ত হয়ে গেল সব। বিলকিসকে হঠাৎ রক্তের মধ্যে আপন করে অনুভব করে আবু। মনে হয় তার মাথার ভেতর থাকে একটা শক্তি ফেটে  ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাসিয়ে দেবে সবকিছু।’ আবুর এ মনস্তত্ত¡ মধ্যবিত্ত প্রবণতার, এমনটার রূপায়ণে একটা গ্লানি, ক্লেদ ও অবক্ষয়চিন্তায় এক ধরনের অস্তিত্ত¡ উন্মূলতার প্রভাব নজরে আসে। মধ্যবিত্ত পরিবারের আবেগ, উন্নাসিকতা, রোমান্টিকতার বিরূপ বসতি এবং দ্ব›দ্বসঙ্কুলচিত্তের চিত্রনাট্য অনুপম দিন-এর কাহিনি। 

নীলদংশন (১৯৮১)

নীলদংশন (১৯৮১)এ-লেখকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক  উপন্যাস। ‘নীলদংশনে নীলকণ্ঠ যন্ত্রণার যে হলাহল ধারণ করতে হলো নজরুলকে, তার কারণ সে বাঙালি’; বাবা কাজী সাইফুল ইসলাম, ছেলে কাজী নজরুল ইসলাম। যুদ্ধ শুরু হলে জাফরগঞ্জে যওয়ার পথে ধৃত হয়। তারপর নজরুল বিতর্ক; ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ প্রেরণা হলে সে ‘জয়বাংলা’র লোক, ভারতের অনুচর। নজরুল ‘নজরুল’কে অস্বীকার করে না; দুঃসহ নির্যতনেও চেতনা অবসিত হয় না, মনঃপীড়নে স্ত্রী-পুত্র-পরিবার ছায়া ফেললেও চেতনাদর্শ কাজী সাইফুলের ছেলে নজরুলের অমলিন। এখানে দায়বোধের বিষয়টিই তার নীলকণ্ঠ-যন্ত্রণা। ছোট্ট পরিসরে, ছোট একটি বিষয়কে সৈয়দ  শামসুল হক খুব শক্তিশালী শৈলীতে বাধেন। ফলে তা হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্যময় তত্ত¡। 

নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১)

আরেকটি উপন্যাস সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১)। ঢাকা ছেড়ে বিলকিসের গ্রামে ফেরার পথে অনিশ্চয়তা, অবরুদ্ধতা, নিরাপত্তাহীনতার চালচিত্র উপন্যাসটি। মুক্তিযুদ্ধ-বর্ণিত হয় তীব্র শ্লেষাত্মক ইঙ্গিতে মৃগয়ায় কালক্ষেপ (১৯৮৬) অর্থে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে বিলাসী জীবনে; বাংলাদেশের ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করেছে; ঝড় তুলেছে চায়ের কাপে তাদের প্রতি ইঙ্গিত করে লিখিত। ভুঁইফোঁড় মধ্যবিত্তের-অস্তিত্ব আর প্রতারক-প্রবঞ্চক; সুযোগে আবার এই যুদ্ধ নিয়েই ফায়দা লোটেআবদুল হাদী; লেখক বলেন, ‘মুক্তির জন্য কষ্ট করতে ভয় পায়... সে যে আশা করে , অথচ প্রকাশ্যে নিজের কাছে পর্যন্ত স্বীকার করে না...।’ কিন্তু নিশ্চিত জয়ের পর্বে সবাই (যেমন বাহাউদ্দিনের পরিবার, হাইকমিশনের কুটনীতিক, বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটির নেতৃবৃন্দ) সমর্থনের জন্য আকুল। সৈয়দ শামসুল হক এভাবেই উপন্যাসকে বাস্তবচিত্রের সঙ্গে কার্যকরি করে তোলেন। সেখানে নির্মিত শৈলীই তার অঙ্গীকার। 

সীমানা ছাড়িয়ে

সীমানা ছাড়িয়ে (মাওলা ব্রাদার্স সং. ১৯৭৩) পূর্ব-বাংলার  আর্থ-সামাজিক-রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে রচিত। জরিনা পূর্ণাঙ্গ চরিত্র। উপন্যাসে শামসুল হক সাবলীল, সংযমী, চিন্তানিষ্ঠ। আয়না বিবির পালা (১৯৮৬)য় গীতিকার কাঠামোতে কাহিনি বয়ান করেন লেখক। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মানুষের গ্রাম ছেড়ে শহরে ছোটা, বিদেশ পাড়ি দেওয়ার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত। তেমনি করে শহরেও বস্তিপলি, পতিতাপলিসহ নানা অপরাধের মোকামে পরিণত। তখন আয়নারা প্রথাবদ্ধ নারীর যাবতীয় সংস্কার ও বিশ্বাস নিয়ে শহরে আসে। মহুয়া পালার অনুসৃতিতে কাহিনিটি রচনা করেন লেখক। বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ একটি আকর্ষণীয় উপন্যস। কবিতা কিংবা লোকজ চেতনা বা ইতিহাস এখানে বর্ণিত। মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে জলেশ্বরী জনপদের গেরিলা কাহিনি এতে থাকলেও যুক্ত হয়েছে সামগ্রিক জনচেতনার কথা। উপস্থাপনভঙ্গিওে সৈয়দ হক এখানে স্বতন্ত্র। 

এক মহিলার ছবি (১৯৫৯), দেয়ালের দেশ (১৯৫৯), অচেনা(১৯৬২), অচিন্ত্য পূর্ণিমা (১৯৬২), জনক ও কালোকফি (১৯৬২), সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪), খেলারাম খেলে যা (১৯৭৩), দূরত্ব (১৯৮১), ত্রাহি (১৯৮২), অন্য এক আলিঙ্গন (১৯৮২), দ্বিতীয় দিনের কাহিনী (১৯৮৪), স্মৃতিমেধ (১৯৮৬), স্তব্ধতার অনুবাদ (১৯৮৬), এক যুবকের ছায়াপথ (১৯৮৭), নির্বাসিতা (১৯৮৭), কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন (১৯৮৯), স্বপ্ন সংক্রান্ত (১৯৮৯), না, যেওনা (১৯৮৯), বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (১ম খÐ-১৯৮৯, ২য় খÐ-১৯৯০), বারো দিনের শিশু (১৯৮৯), বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল (১৯৮৯), ত্রাহি (১৯৮৯), তুমি সেই তরবারি (১৯৮৯), কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন(১৯৮৯), শ্রেষ্ঠ উপন্যাস (১৯৯০), নির্বাসিতা (১৯৯০), মেঘ ও মেশিন (১৯৯১), ইহা মানুষ (১৯৯১), কালধর্ম (১৯৯২), আমি বাসি তুমি বাসোতো (১৯৯৩), মহাশূন্যে পরাণ মাস্টার (১৯৯০), দ্বিতীয় দিনের কাহিনী (১৯৯০), বালিকার চন্দ্রযান (১৯৯০), জেসমিন রোড (১৯৯২), চোখবাজী (১৯৯৪), টানটান (১৯৯৪), অন্তর্গত (১৯৯৫), আলোর জন্য (১৯৯৫), বুকঝিম এক ভালোবাসা (১৯৯৬), একমুঠো জন্মভূমি (১৯৯৭), বৃষ্টি ও বিদ্রাহীগণ (১৯৯৭), যৌবন (১৯৯৭), শঙ্খলাগা যুবতী ও চাঁদ (১৯৯৮), নারীরা (১৯৯৯), বাস্তবতার দাঁত ও করাত (১৯৯৯), উড়ে যায় মালতী পরী (২০০৫) প্রধানত বাঙালি মধ্যবিত্তের ক্রম-উত্তরণ ও রূপান্তরের পর্বটি অঙ্কন করেন সৈয়দ শামসুল হক। এক্ষেত্রে শহর কিংবা গ্রাম দুই’ই তাঁর বিষয়বন্দি হয়েছে। স্বাধীনতা-পূর্ব এবং পরবর্তী সময়ে ক্রমবিকশিত মধ্যবিত্তের মনোজগত, বিকারগ্রস্ততা, যৌনতা, অচরিতার্থতা, স্ববিরোধীতা বিচিত্রভাবে নিরীক্ষিত হয়েছে তাঁর উপন্যাসে। কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় শ্রেণিচরিত্রের  সংঘাত ও সংগ্রামের রূপরেখা কিংবা বহমান লোকায়ত জীবনাচরণের সংস্কৃতির পুনর্নির্মাণ-প্রতিষ্ঠা হয়েছে উপন্যাসে। তবে প্রধানত চরিত্রের স্বরূপানুসন্ধানের প্রত্যয়টিই শিল্পবন্দি তাঁর লেখায়। ২০০৬ সাল পর্যন্ত সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস সমগ্র-র সাতটি খণ্ড  বেরিয়েছে ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

buttons=(Accept !) days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !
To Top