হান কাংয়ের লেখা 'হিউম্যান অ্যাক্টস': এক স্মৃতি ও মুক্তির গান

0

 হান কাংয়ের লেখা 'হিউম্যান অ্যাক্টস': এক স্মৃতি ও মুক্তির গান

হান কাংয়ের উপন্যাস 'হিউম্যান অ্যাক্টস' যেন এক শোকগাথার কাব্য, যা আমাদের নিয়ে যায় ১৯৮০ সালের দক্ষিণ কোরিয়ার গুয়াংজু শহরে, যেখানে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় খোদাই হয়েছিল রক্তাক্ত ঘটনা—গণতন্ত্রকামী ছাত্রদের ওপর সেনাবাহিনীর নির্মম হামলা। এই উপন্যাসে কাং আমাদের জন্য একটি এমন পৃথিবী তুলে ধরেছেন, যেখানে মৃত্যু আর বেঁচে থাকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের আতঙ্ক, শোক, আর স্মৃতির ভার।

গুয়াংজু হত্যাকাণ্ড: ইতিহাসের ছায়ায় লেখা এক গল্প

১৯৮০ সালের মে মাসের সেই দিনগুলোতে, গুয়াংজুর রাস্তায় রক্ত ঝরেছিল, জীবনের আলো ম্লান হয়ে গিয়েছিল অসংখ্য মানুষের জন্য। হান কাং তাঁর উপন্যাসে সেই রক্তমাখা ইতিহাসের গভীরে প্রবেশ করেছেন। গল্পটি শুরু হয় পনেরো বছর বয়সী ডং হো নামের একটি ছেলের দৃষ্টিকোণ থেকে, যে তার বন্ধুকে খুঁজতে গিয়ে ছাত্রদের আন্দোলনের মাঝে আটকে পড়ে। সেই শোক আর মৃত্যু-উপলব্ধির আঘাত ডং হোর জীবনে যেমন বিরাট পরিবর্তন আনে, তেমনই পাঠকদের মনেও প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়।

এই উপন্যাসে, হান কাং ইতিহাসের সেই নির্মম অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে কেবল ডং হোরই নয়, বরং আরও অনেকের গল্প শোনান—তাদের, যারা এই হত্যাযজ্ঞে কোনও না কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তিনি আমাদের শোনান একটি মায়ের শোক, একটি মৃত বন্ধুর আত্মার যন্ত্রণা, এবং সেইসব মানুষের গল্প, যারা যুদ্ধ এবং হত্যা দেখেছে কাছ থেকে।

কাব্যিক ভাষা আর মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা: হান কাংয়ের লেখার বিশেষত্ব

হান কাংয়ের ভাষা যেন কাব্যের মতোই মসৃণ, তবু তাতে লুকিয়ে থাকে এক ধরনের তীক্ষ্ণতা, যা আমাদেরকে মর্মে মর্মে আঘাত করে। 'হিউম্যান অ্যাক্টস' এর প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি বর্ণনা যেন এক কাব্যিক পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরে। উপন্যাসে ‘তুমি’ সর্বনামের ব্যবহার যেন এক বিশুদ্ধতা যোগ করে, যেখানে পাঠকও যেন এক অদৃশ্য চরিত্র হয়ে যায় এই শোকগাঁথার অংশ। কাংয়ের ভাষা এমনভাবে সাজানো, যা আমাদেরকে নিয়ে যায় অতীতের গহ্বরে, যেখানে শোকের ভেতর দিয়ে আমরা খুঁজে পাই মানবতার রূপান্তর।

এই উপন্যাসে কাং কেবল ইতিহাসের চিত্র আঁকেন না, বরং আমাদের মনে জন্ম দেন কিছু প্রশ্ন—যেমন, সরকার বদলায়, কিন্তু মানুষের উপর থেকে নিপীড়ন কেন কমে না? স্বাধীনতা শব্দটির প্রকৃত অর্থ কী? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা খুঁজে পাই না, কিন্তু কাং আমাদের নিয়ে যান একটি যাত্রায়, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে আমরা সেই উত্তরগুলোর দিকে অগ্রসর হই।

মানবিকতার চরম পরীক্ষা: শোক আর সাহসের গল্প

'হিউম্যান অ্যাক্টস' আমাদেরকে মানবিকতার গভীরতম স্তরে পৌঁছে দেয়। এখানে একদিকে আছে শোক, অপূর্ণতা, আর আতঙ্ক, আর অন্যদিকে আছে সাহস, যা আমাদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্ররোচিত করে। উপন্যাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে আমরা দেখি কিভাবে গণতন্ত্রকামী মানুষদের মিছিল থেকে ভেসে আসে জাতীয় সংগীতের সুর, যেন সেই সুরের মধ্যে তারা তাদের জীবনের শেষ আর্তনাদ তুলে ধরে।

হান কাংয়ের এই রচনা শুধু একটি উপন্যাস নয়, এটি এক ধরনের মানবিক দলিল, যেখানে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতা আর মানুষের আশাহীন সংগ্রাম একে অপরকে ছুঁয়ে যায়। আমাদের প্রত্যেককে এই উপন্যাস মনে করিয়ে দেয়, আমরা কাচের তৈরি মানুষ, ভঙ্গুর কিন্তু স্বচ্ছ, যারা ভাঙনের মধ্য দিয়েই নিজেদের শুদ্ধতা খুঁজে পায়।

‘হিউম্যান অ্যাক্টস’: এক স্মৃতি ও মুক্তির গান

হান কাংয়ের 'হিউম্যান অ্যাক্টস' এমন এক উপন্যাস, যা পাঠকের মনকে কাঁপিয়ে তোলে। এটি একটি শোকগাথা, একটি মানবতার গান, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ইতিহাসের মলিন পৃষ্ঠাগুলো এখনও জীবন্ত। এই উপন্যাসে জীবনের গল্প আছে, মৃত্যুর গল্প আছে, আর আছে সেইসব প্রশ্ন, যা আমাদের আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। হান কাং তাঁর কাব্যিক ও গভীরতর বর্ণনার মাধ্যমে এই উপন্যাসকে এক শুদ্ধ শিল্পকর্মে পরিণত করেছেন, যা কেবল কোরিয়ান সাহিত্যের নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যেরও অমূল্য সংযোজন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

buttons=(Accept !) days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !
To Top