হাসুলী বাঁকের উপকথা
বাংলা কথাসাহিত্য ধারায় বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের বিংশ শতকের উত্তরসূরী হিসেবে সর্বাথে আসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৮-১৯৭১) নাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় । ধর্মীয় শিক্ষার অবাধ অনুশীলন ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব- এই দুইয়ের মিথস্ক্রিয়ায় তরাশঙ্করের মানস গঠিত হয়েছিল। “হাসুলী বাঁকের উপকথা " তারাশঙ্করের অনন্য উপন্যাস। এই উপন্যাসে তারাশঙ্কর ভূমি নির্ভর আভিজাত্য বোধে জারিত জীব ব্যবস্থার মাঝে বিত্ত-মর্যাদা-সচেতন অর্থদৃপ্ত অহমিকার অনুষঙ্গ উপস্থাপন করেছেন ।
হাঁসুলী বাঁকের উপকথা বিষয়বস্তু
এখানে উঠে এসেছে লোকায়িত জগতের অতলে লুকিয়ে থাকা এক আদিম সমাজচিত্র। এই উপন্যাসের সূত্রে আমরা বাংলা উপন্যাসের আলাদা মানচিত্রে, আলাদা ভূগোলে প্রবেশ করি। এতে বীরভূমের কাহার বাউরী সম্প্রদায়ের জীবনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। তাদের জীবন, সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস, আচার-আচরণ, লৌকিকতা আন্তরিকতার সাথে তুলে ধরা হয়েছে। কোপাই নদীর বৃত্তাকার ধরনের বাক নারীর গলার অলংকার হাসুলীর অনুরূপ । উপন্যাসের বলা হয়েছে- “কোপাই নদীর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় বিখ্যাত বাকটার নাম হাঁসুলী বাঁক। অর্থাৎ যে বাঁকটায় অত্যন্ত গয়নার মত।” এই বাকে বাঁশ-বেতের গভীর জঙ্গল । সূর্যের আলো সেখানে পৌছায় না। এই জঙ্গলে বসবাস কাহারদের। কাহার কোন জাত নয় পালকীবাহক সম্প্রদায়। কাহার হলো “কীধ' এবং “ভার' শব্দের একত্রিকরণ অর্থাৎ যারা কাধে ভার-বয় তারাই কাহার।
লেখক নিজেও বলেছেন-
“কাহার বলে কোন নির্দিষ্ট জাতি নেই। হরিজনদের মধ্যে যারা পাক্ধী বয় তারা কাহার-বাগদীদের মধ্যে যারা পাক্কী বয় তারা বাগদি কাহার ।”
কাহারদের গ্রামের নাম বাশবাদি। গ্রামের দু'ধরনের কাহারদের বাস। আটপৌরে কাহার আর বেহারা কাহার । “গোরার বাধ' বলে মাঝারি একটি পুকুরের পাড়ের ওপর কয়েকটা ঘরে আটপৌরেদের বাস। আটপৌরে কাহাররা একসময় জমিদার, নীলকরদের লাঠিয়াল ছিল। পরবর্তীতে তারা চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পরে । আর বেহারা কাহারদের পূর্বপুরুষ ছিল পালকি বাহক। বর্তমানে তারা পাশের ভদ্রলোকের গ্রাম জাঙলের বাবুদের জমি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ
করে। পাশাপাশি সুযোগ পেলে একটু আধটু পালকি বাহকের কাজও করে। কাহারদের সমাজ লৌকিক দেবতার নির্দেশে পরিচালিত হয় । তাদের সকল আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয় কুসংস্কার লোকবিশ্বাস রীতি-প্রথার মত কঠোর অনুশাসন ছ্বারা। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই রাঢ় অঞ্চলের অন্ত্যজ সমাজের ছবি অঙ্কন করেছেন।
হাঁসুলি বাঁকের উপকথা করালী চরিত্র
উপন্যাসের প্রধানতম চরিত্র বনোয়ারী, করালী। কাহারদের মাতব্বর বনোয়ারী। বনোয়ারী প্রাটীনপন্থী এবং কুসংস্কারপূর্ণ নিয়মনীতিতে বিশ্বাসী । সে চায় কাহাররা তাদের পূর্বপুরুষদের পেশা পালকিবাহকগিরি এবং জমিচাষাবাদই করুক পুরাতন সব রীতিনীতি মেনে চনলুক। কিন্তু করালী নামে এক বিদ্রোহী তরুণ ভার বিপরীত। সে এসব নিয়ম কানুন মানে না। সে কাহারদের পুরাতন পেশাকে জলাঞ্জলি দিযে চননপুরের কারখানাতে চাকরি নেয়। বনোয়ারীর দৃষ্টিতে করালীর এ কাজ জাত যাওয়ার সমতুল্য। এ থেকে করালী বনোয়ারীর দন্ড শুরু হয়।
জননী কাহার জম্প্রদায়ের নিকট সাপ হল দেবতা । করালী একটি সা মেরে ফেললে মাতব্বর বনোয়ারী পুরো সম্প্রদায়কে দেবতা হত্যার পাপে পাপী মনেকরে। কিন্তু করালী কাহারদের এসব কুসংক্কারাচ্ছন্ন আচারকে পাত্তা দেয় না। কোন অন্যায় অবিচারও সে মুখবুজে সহ্য করে না। সে চায় কাহাররা বাবুদের গোলামী বাদ দিয়ে তার মত কল-কারখানায় চাকরি করুক, একটু সচ্ছলতার মুখ দেখুক। তাই সে গোষ্ঠীর নিয়মের তোয়াক্কা না করে বনোয়ারীর নিষেধ সত্ত্বেও রেলস্টেশনে কুলির কাজ করে নগদ অর্থ উপার্জন শুরু করে এবং একসময় সে শহরে গিয়ে বসবাস শুরু করে। বাশখালি গ্রামের তরুন কাহাররা করালীর ভক্ত। করালীর প্রেমে সারা দিয়ে অসুস্থ স্বামীকে ফেলে রূপবতী যুবতী পাখীও করালীর সাথে শহরে যায়। করালীকে অনুসরণ করে যুবক সম্প্রদায়ের অনেকেই শহরে যেতে থাকে। ব্যর্থ হতে থাকে বনোয়ারী।
এ উপন্যাসে রয়েছে দুটি সমান্তরাল কাহিনির শ্বোত। এক. বাশবীদি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কোপাই নদীর বিখ্যাত হাসুলি বাকের কাহার সম্প্রদায়ের জীবন সংহতির অনিবার্য ভাঙন, কৃষি নির্ভর জীবনের ক্রমবশান এবং বাশ-বন ঘেরা উপকথার হাসুলি বাকের বিরান প্রান্তরে পরিণত হওয়ার কাহিনি। দুই. কাহার সম্প্রদায়ের উচ্ছেদ ও বুর্জোয়া ধনতান্ত্রক সমাজের যন্ত্রকলে তাদের দাসে পরিণত হবার কাহিনি। উপন্যাসিক দেখাতে চেয়েছেন হীসুলি বাকের গোষ্ঠী জীবনের বিনাশের ইতিহাস অর্থাৎ মূল্যবোধের বিপর্যয়ের ফলে স্বঘাম থেকে উচ্ছেদের কাহিনি। তবে উপন্যাসের শেষে করালীকে হাসুলি বাকে ফিরিয়ে এনে এ বাককে সরব করেছেন।
এ উপন্যাসে সাপ আর নদী দুটি প্রতীক একটি হলো যুগযুগ ধরে জমে থাকা কাহারদের ভিতর ও বাইরের জীবনের অন্ধকারের গতির প্রতীক । আরেকটি হলো এ অচলতার মাঝে গতির প্রতীক। এছাড়া এই সম্প্রদায়ের আত্মবিরোধ, পরিবর্তন ও বিনৃপ্তি যেমন কাহিনির প্রধান ধারা আর একটি ধারা হুল প্রাচীন সমাজের সঙ্গে নতুন পরিবর্তনশীল জগতের সংঘাত। সেই সঙ্গে আছে এক আদিম মানবিক সংগ্রাম।
এই উপন্যাসে একটি ক্ষীয়মাণ জনগোষ্ঠীর জীবনসংযাম আর প্রাত্যহিক সুখ-দুঃখের গল্প উঠে এসেছে। 'হীসুলী বাকের উপকথা র উৎসর্গ পত্রে তারাশঙ্কর কবি কালিদাস রায়ের উদ্দেশ্যেঅবলীলায় লেখেন- 'রাছের হাসুলি বাকের উপকথা আপনার অজানা নয়।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যান সাহিত্য কর্ম ঃ
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক, যিনি সমাজের নানা স্তরের জীবনচিত্র এবং মানুষের মনের গভীরতা অন্বেষণ করেছেন তার উপন্যাস ও ছোটগল্পের মাধ্যমে। তার কিছু উল্লেখযোগ্য বই ও উপন্যাস হলো:
১. গণদেবতা
- এই উপন্যাসে বাংলার গ্রামীণ জীবনের সংগ্রাম, দুর্দশা ও ঐতিহ্যের মিশ্রণে এক সমৃদ্ধ সামাজিক চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। কৃষকদের সংগ্রাম এবং তাদের প্রতি জমিদারদের অন্যায় অত্যাচারকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
২. কবি
- প্রেম, আবেগ এবং সাংস্কৃতিক সংঘাত নিয়ে লেখা এই উপন্যাসে গ্রামের এক সাধারণ গায়ক (বাউল) ও তার জীবনসংগ্রাম তুলে ধরা হয়েছে। উপন্যাসটি খুবই জনপ্রিয় এবং বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী রচনাগুলির মধ্যে অন্যতম।
৩. ধাত্রীদেবতা
- এই উপন্যাসটি মাতৃত্ব, সংস্কার এবং সমাজের উপর ভিত্তি করে লেখা। গ্রামীণ নারীদের জীবনের নানা দিক এবং তাদের প্রতিদিনের সংগ্রাম এখানে চিত্রিত হয়েছে।
৪. আরোগ্য নিকেতন
- এই উপন্যাসটি বাংলার গ্রামীণ সমাজের প্রাচীন ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সংঘাতের কাহিনী। কাহিনিতে চিকিৎসক ব্রাহ্মণ পরিবারের তিন প্রজন্মের জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
৫. পঞ্চগ্রাম
- পঞ্চগ্রাম বাংলার পাঁচটি গ্রামের সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, এবং মানুষের নৈতিক জীবনের নানা দিকের একটি চিত্র তুলে ধরে। এটি তারাশঙ্করের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামাজিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটি।
৬. চৈতালী ঘূর্ণি
- গ্রাম বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসটি মানুষের মানসিকতা এবং মনোবিজ্ঞানকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে।
৭. জলসাঘর
- এই উপন্যাসে জমিদার পরিবারের পতন এবং তাদের জীবনধারার পরিবর্তনের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। উপন্যাসটি পরে চলচ্চিত্রেও রূপায়িত হয়েছে এবং বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
৮. দুটি পৃথিবী
- দুটি সমাজের মানসিকতা এবং জীবনের বিভিন্ন দিকের মধ্যে সংঘাতের কাহিনী। এখানে দুই ভিন্ন সামাজিক স্তরের মানুষের জীবনচিত্র দেখানো হয়েছে।
৯. হাঁসুলী বাঁকের উপকথা
- এটি তারাশঙ্করের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। রাঢ় বাংলার কাহার সম্প্রদায়ের জীবন, সংস্কৃতি এবং পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে।
১০. শ্রীকান্তচন্দ্র
- এই উপন্যাসটি একটি গভীর মানবিক কাহিনী, যেখানে প্রাচীন ও আধুনিক সমাজের মধ্যে সংঘাত এবং সংস্কারের পরিবর্তনশীল চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
তারাশঙ্করের লেখা উপন্যাস এবং ছোটগল্পগুলিতে বাংলার সমাজের নানা স্তর, মানুষের অনুভূতি এবং জীবনযাত্রার নানা রূপ তুলে ধরা হয়েছে, যা তাকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে তুলেছে।