বদরের যুদ্ধের কারণ,ঘটনা ও ফলাফল:
বদর যুদ্ধের কারণসমূহ
মদিনা থেকে প্রায় আশি মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি বাণিজ্যকেন্দ্রের নাম বদর। তখনকার দিনে এখানে পানির প্রাচুর্য থাকায় স্থানটির গুরুত্ব ছিল অত্যাধিক। এখানেই দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমযান মোতাবেক ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ শুক্রবার ইসলামের ইতিহাসের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটা বাহ্যত যুদ্ধ মনে হলেও বাস্তবে পৃথিবীর ইতিহাসে এর ফলে একটি সুমহান বিপ্লব সূচিত হয়েছিল। এ কারণেই কুরআনের ভাষায় একে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ বলা হয়েছে। পাশ্চাত্যে ইতিহাসবিদরাও এর গুরুত্ব স্বীকার করেন। ঐতিহাসিক পি কে হিট্টি তার ‘ History of the Arabs’ গ্রন্থে একে ইসলামের প্রকাশ্য বিজয় বলে অভিহিত করেছেন।
এ যুদ্ধের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো:
কুরাইশদের গাত্রদাহ
মদিনায় মুহাম্মদ (সা.)-এর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা ও ইসলামের দ্রুত প্রসার কুরাইশদের মনে ঈর্ষা ও শত্রুতার উদ্রেক করে। তাই তারা মুহাম্মদ (সা.)-কে মদিনা থেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র আঁটে।
মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র
পাপিষ্ঠ মুনাফিক দলের সঙ্গে যোগসাজশ করে ইহুদিরা সংঘবদ্ধ হয় এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) তথা ইসলামের ধংস সাধনের জন্য গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করে।
অর্থনৈতিক কারণ
নির্বিঘেড়ব ব্যবসায়-বাণিজ্য করার সুযোগ হারাতে হতে পারে, এ আশঙ্কায় কুরাইশরা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। ব্যবসায় ও মক্কার কাবা ঘরে গমনকারীদের চলাচল বন্ধ হলে সমূহ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে উপলব্ধি করে কুরাইশরা ইসলামের মূলোৎপাটনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, “মক্কার ব্যবসায়ীরা সিরিয়া, মিসর, মেসোপটেমিয়া প্রভৃতি দেশের সাথে নিয়মিত ব্যবসায়-বাণিজ্য করতো, কিন্তু মদিনা মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার ফলে মদিনার মধ্য দিয়ে কুরাইশদের একমাত্র বাণিজ্যপথ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
ইহুদিদে ষড়যন্ত্র ও শর্তভঙ্গ
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর μমবর্ধমান প্রতিপত্তি ইহুদিরা সহ্য করতে পারেনি। তাই সুবিধাভোগী কিছু ইহুদি নেতা মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুনাফিকদের সাথে মিশে নানাভাবে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। বিশ্বাসঘাতক ইহুদিরা মদিনা সনদের শর্ত ভঙ্গ করে কুরাইশদের মদিনা আক্রমণে প্ররোচিত করে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহানুভবতা ও সহনশীলতার সুযোগে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলে তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে বদর যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়।
কুরাইশদের যুদ্ধের হুমকি
মদিনাবাসীদের সঙ্গে মক্কার লোকদের বরাবরই ভালো সম্পর্ক ছিল, কিন্তু নবী করীম (সা.) ও তাঁর অনুসারীরা মদিনায় গেলে তাদের পূর্বের সে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। তাই কুরাইশরা মদিনাবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দেয়।
আবু সুফিয়ানের অপপ্রচার
মক্কার কুরাইশ কাফির নেতা আবু সুফিয়ান ব্যবসায় বাণিজ্যে আবরণে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য কাফেলা নিয়ে সিরিয়ায় গমণ করে। এ কাফিলায় প্রায় ৫০,০০০ দিনার মূল্যের ধন-রতড়বাদি ছিল। নাখলার যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে কুরাইশরা সিরিয়ায় গমনকারী কাফিলার মক্কায় নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। মক্কায় জনরব ওঠে, আবু সুফিয়ানের কাফিলা মদিনার মুসলিমদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। গুজবের সত্যতা যাচাই না করে আμমণাত্মক নীতি অনুসরণ করে আবু জাহল এক হাজার সৈন্য নিয়ে আবু সুফিয়ানের সাহায্যার্থে বদর অভিমুখে রওয়ানা হয়।
কুরাইশদের দস্যুবৃত্তি
বদর যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে কুরাইশদের দস্যুবৃত্তিকে একটা বড় কারণ বলে ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন। মদিনার সীমান্তবর্তী এলাকায় কুরাইশ এবং তাদের অনুগত সহযোগী আরব গোত্রগুলো মুসলিমদের শস্যক্ষেত্রে জ্বালিয়ে দিত, ফলবান বৃক্ষ ধ্বংশ করতে এবং উট, ছাগল ইত্যাদি অপহরণ করতো। সুতরাং এহেন কার্যকলাপের কারণে রাসূলুল্লাহ (সা.) আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হন।
নাখলা প্রান্তরে খন্ড যুদ্ধ
মদিনা সীমান্তে কুরাইশদের μমবর্ধমান লুটতরাজ বন্ধ করার জন্য গোপন সংবাদ সংগ্রহে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহশের নেতৃত্বে একটি গোয়েন্দা দল দক্ষিণ আরবের নাখলায় প্রেরণ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) কুরাইশ কাফিলাকে আক্রমন করতে আদেশ না করা সত্তে¡ও আবদুল্লাহ (রা) ভুলবশত কাফেলার সঙ্গে সংঘর্ষে রত হলে নাখলায় এক খন্ডযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়।
আরও পড়ুন -----
ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাস
উহুদ এর যুদ্ধ ,কারন ও ফলাফল
বদরের যুদ্ধের ঘটনা
মদিনা আক্রমনের জন্য মক্কার কাফিররা প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসছে- এ সংবাদে রাসূলুল্লাহ (সা.) খুবই চিন্তিত হয়েত পড়েন। এমতাবস্থায় আল্লাহর এ নির্দেশ পেয়ে চিন্তামুক্ত হন। “আল্লাহর পথে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর, যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে, তবে সীমালঙ্ঘন করো না, কারণ আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।
৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ (১৭ রমযান দ্বিতীয় হিজরী) রাসূলুল্লাহ (সা.) ২৫৬ জন আনসার এবং ৬০ জন মুহাজির নিয়ে যুদ্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রণাসভার পরামর্শ অনুযায়ী গঠিত একটি মুসলিম বাহিনীসহ কুরাইশ বাহিনীর মোকাবেলার জন্য বের হন। মদিনা থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর উপত্যকায় মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে কুরাইশদের সংঘর্ষ হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
আল-আরিসা পাহাড়ের পাদদেশে মুসলিম বাহিনীর শিবির স্থাপিত হয়। ফলে পানির কূপগুলো তাদের আয়ত্তে ছিল। ঐতিহাসিক ওয়াকিদী বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) মুসলিম সৈন্য সমাবেশের জন্য এমন এক স্থান বেছে নেন যেখানে সূর্যোদয়ের পর যুদ্ধ শুরু হলে কোনো মুসলিম সৈন্যের চোখে সূর্য কিরণ না পড়ে।” প্রাচীন আরব-রেওয়াজ অনুযায়ী প্রথমে মল্লযুদ্ধ হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশে হযরত আমীর হামযা, আলী ও আবু ওবায়দা কুরাইশ নেতা ওতবা, শায়বা এবং ওয়ালিত ইবনে ওতবার সঙ্গে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এতে শত্রু পক্ষের নেতৃবৃন্দ শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হয়। উপায়ন্তর না দেখে আবু জাহল নিজের বাহিনীসহ মুসলিম বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা মুসলিমদের ওপর প্রচণ্ড ভাবে আক্রমন করতে লাগল, কিন্তু প্রতিকূল অবস্থা এবং সংঘবদ্ধ সুশৃঙ্খল মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলা করা কুরাইশদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অসামান্য রণনৈপুণ্য, অপূর্ব বিক্রম ও অপরিসিীম নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে যুদ্ধ করে মুসলিমগণ বদরের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে কুরাইশদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। অপরদিকে আবু জাহল ৭০ কুরাইশ সৈন্যসহ নিহত হয় এবং সমসংখ্যক কুরাইশ সৈন্য বন্দি হয়। এ যুদ্ধে মাত্র ১৪ জন মুসলিম সৈন্য শাহাদাত বরণ করেন।
সংক্ষেপে বদরের যুদ্ধের ঘটনা :
বদর যুদ্ধে কুরাইদের ১০০০ সৈন্য নিয়ে হযরত মুহাম্মদ (স.) ৬২৪ খ্রিঃ ১৭ই মার্চ (১৭ই রমজান, ২য় হিজরি) ৩১৩ জন মুজাহিদ নিয়ে গঠিত একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে মদিনার প্রায় ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর নামক স্থানে যুদ্ধ সংঘঠিত হয় ।বদর যুদ্ধে আবুজেহেলসহ মোট ৭০ জন কুরাইশ নিহত এবং ৭০ জন বন্দি হয় । মুসলমানদের পক্ষে মাএ ১৪ জন শাহাদাত্ বরণ করে ।
বদরের যুদ্ধের |
এ যুদ্ধে নবীর দুটি দাঁত মোবারক শহীদ হয়]
আরও পড়ুন -----
ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাস
উহুদ এর যুদ্ধ ,কারন ও ফলাফল
বদর যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব :-
ইসলামের ইতিহাসে বদরের যুদ্ধের গুরুত্ব ও তাত্পর্য অপরিসীম । এ যুদ্ধের সাথে মুসলমানদের আস্তিত্ব ও ইসলামের ভবিষ্যত্ জড়িত ছিল। মুসলিম শক্তি এ যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ব জয়ের সোপানে আরোহণ করে। এ যুদ্ধে কুরাইশ শক্তিকে পর্যুদস্ত করে মুসলিমরা প্র ম বারের মতো বিশ্বময় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার প্রসারের দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
ঐতিহাসিক নিকলসন বলেন-
The Battle of Badar is not only the most celebrated battle in Muslims' memories, but it was also of great historical importance.
ঐতিহাসিক যোসেফ হেল বলেন,
“বদরের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে প্রথম বড় ধরনের সামরিক বিজয়।” এ যুদ্ধে কাফিরদের ওপর মুসলিমদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। বিশাল কাফির বাহিনী অল্পসংখ্যক মুজাহিদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এ যুদ্ধ বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম বিজয়ের যুগে প্রবেশ করে।
হিট্টি যথার্থই বলেছেন- Islam recovered and passed on gradually from the defensive to the offensive.. হিট্টির মতে,
“বদরের প্রান্তরে সম্মুখ যুদ্ধে মুসলিমগণ মৃত্যুকে উপেক্ষা করে নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তা তাদের পরবর্তী বিজয়ের পথকে সুগম করে। এ বিজয় দ্বীনের সূচনা করে এবং পরবর্তী একশ বছরের মধ্যে ইসলাম পশ্চিম আফ্রিকা থেকে পূর্বে ভারত উপমহাদেশ ও মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।”
বদরের যুদ্ধ মদিনা রাষ্ট্রকে সুসংবদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্রে উপনীত করে। বিজয়ীর বেশে মদিনায় ফিরে মহানবী (সা.) সুদক্ষ সমর নেতা, পরাক্রমশালী ও ন্যায়পরায়ণ শাসকে পরিণত হন। এমনকি বদর যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মুসলিমদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়। মুসলিমগণ প্রচুর গনীমত লাভ করে। এতে ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হয়। বদরের যুদ্ধের বন্দিদের সাথে রাসূল (সা.) মহত্ত¡পূর্ণ উদার আচরণ করেন। ফলে তাদের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে। এতে ইসলামের নৈতিক ও মনস্তাত্তিক বিজয় সাধিত হয়। এ যুদ্ধ বিজয়ের মাধ্যমে বিজয়ের যুগে প্রবেশ করে। সর্বোপরি বদর যুদ্ধে স্বল্পসংখ্যক মুসলিম সেনার জয়লাভ ছিল একটি চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারক ঘটনা।
আরও পড়ুন -----
ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাস
উহুদ এর যুদ্ধ ,কারন ও ফলাফল