ঢাকা শহরের ইতিহাস
ঢাকা শহরের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। এটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসকের অধীনে থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ঢাকা তার বাণিজ্য, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। শহরটি মূলত বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন শাসকের শাসনকালে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র এবং প্রশাসনিক নগরীতে পরিণত হয়।
প্রাচীন যুগ
ঢাকার ইতিহাসের সঠিক উৎস সন্ধান করা বেশ কঠিন, তবে ধারণা করা হয় যে, প্রাচীনকালে এই অঞ্চলে গঙ্গারিডাই সভ্যতার বসতি ছিল। তখন থেকেই বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বিভিন্ন জনপদ ও বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠতে থাকে। এই সময়ে ঢাকা একটি অঞ্চল হিসেবে বিকশিত হচ্ছিল, যদিও এটি তখনও শহর হিসেবে গড়ে ওঠেনি।
সুলতানি যুগ
১৩শ শতকে সোনারগাঁও ছিল পূর্ব বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র। তখন ঢাকা ছিল একটি ছোট্ট জনপদ। তবে, সুলতানি আমলের (১৩৫২-১৫৭৬) শেষ দিকে ঢাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে বিকশিত হয়। ১৪শ শতকে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর, ঢাকাকে স্বাধীন সুলতানি বাংলার একটি ইকলিম (প্রদেশ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সুলতানরা ঢাকার বাণিজ্যিক গুরুত্ব বুঝতে পেরে এখানকার অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।
মোগল আমল
মোগল শাসনামলে ঢাকার ইতিহাসে একটি বড় পরিবর্তন আসে। ১৬০৮ সালে মোগল সুবাহদার ইসলাম খান ঢাকাকে সুবাহ বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি শহরটিকে একটি বাণিজ্যিক, প্রশাসনিক এবং সামরিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। ইসলাম খান শহরটির নামকরণ করেন "জাহাঙ্গীরনগর" মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে। এই সময়ে ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক শহরে পরিণত হয়। মোগল আমলে এখানে মসজিদ, দুর্গ, এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মিত হয়, যা আজও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে টিকে আছে।
ব্রিটিশ আমল
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ঢাকা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে আসে। এই সময়ে শহরটি তার প্রাচীন জৌলুস হারাতে শুরু করে। তবে, ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশরা ঢাকাকে নতুনভাবে উন্নয়নের পথে নিয়ে আসে। ঢাকা তখন পুনরায় একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং এখানে ব্রিটিশরা তাদের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতো। ঢাকায় এই সময়ে অনেক ব্রিটিশ স্থাপত্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে, যার মধ্যে রেলওয়ে এবং সড়ক ব্যবস্থাও ছিল।
পাকিস্তান আমল
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হওয়ার পর ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হয়। এই সময়ে ঢাকার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঢাকা একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ঢাকার রাজপথেই সংঘটিত হয়, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি তৈরি করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়। ঢাকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের প্রধান কেন্দ্র। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
স্বাধীনতার পর
স্বাধীনতার পর ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। শহরটি আধুনিক স্থাপত্যের পাশাপাশি ঐতিহাসিক মোগল ও ব্রিটিশ স্থাপত্যের একটি মিশ্রণ উপস্থাপন করে। ঢাকা তার জনসংখ্যার কারণে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে টিকে আছে।
ঢাকার ইতিহাস তার বহুমুখী সংস্কৃতি, বাণিজ্যিক প্রবাহ, এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে, যা এই শহরকে অনন্য বৈশিষ্ট্য দিয়েছে।